স্টিভ সিবোল্ড নামের একজন মিলিওনিয়ারের মতে, ‘প্রচলিত কুসংস্কারমূলক ধারণাগুলো থেকে বের হতে পারলেই ধনী হওয়া সম্ভব।’ তবে প্রত্যেকে ধনী হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে না।
যেসব ভুলের কারণে আপনার প্রাচুর্যে ভরা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে, সেরকম ১০টি কারণ এখানে তুলে ধরা হলো। আপনার যদি দারিদ্র্যতা লেগেই থাকে তাহলে নিচের পয়েন্টগুলো মিলিয়ে দেখতে পারেন।
* বুদ্ধিহীন গাঁধার খাটুনি: স্কুলে আমরা শিখেছি যে, যে যত পরিশ্রম করে জীবনে সে তত এগিয়ে যায়। ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ এই ভাবসম্প্রসারণের সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত।
রিক এডেলম্যান নামের একজন ফিন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজারের মতে, ‘স্কুল জীবনের এই উপদেশগুলো পরিপূর্ণ না, বাকী অর্ধেক স্কুল থেকে শেখা সম্ভব হয়নি, বাস্তব জীবনে শুধু বেশি বেশি পরিশ্রম করলেই ধনী হওয়া যায় না অর্থাৎ গায়ে খাটলেই ধনী হওয়া যায় না।’
এডেলম্যানের মতে, ধনী হওয়ার জন্য পরিশ্রম করার পাশাপাশি আপনাকে জানতে হবে, কিভাবে কাজ করলে ভালো মানের ফসল দ্রুত ঘরে তোলা যাবে অর্থাৎ পরিশ্রম করার প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের বুদ্ধিকেও কাজে লাগাতে হবে।
জায়গা বুঝে টাকা বিনিয়োগ করাও স্মার্ট (বুদ্ধিদীপ্ত পরিশ্রম) কাজের উদাহরণ বলে তিনি মনে করেন। তিনি পরামর্শ দেন যে, আপনার টাকা এবং ধন সম্পদ বাড়ানোর জন্য শেয়ার বাজার অথবা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। এতে তেমন ঝুঁকি নেই, বেশি পরিশ্রম বা সময়েরও প্রয়োজন নেই।
* বিনিয়োগ করার চেয়ে জমিয়ে রাখার প্রবণতা বেশি: টাকা জমিয়ে রাখতে না চেয়ে কিভাবে উপার্জন বাড়ানো যায় সেদিকে মনযোগ দেয়া উচিত।
ধনী হওয়ার জন্য সঞ্চয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সঞ্চয়ের প্রতি মনযোগ দিতে গিয়ে অর্থ বিনিয়োগ করাকে অবহেলা করবেন না। সিবোল্ড বলেন, ‘সাধারণ মানুষ লটারি ধরে এবং আনন্দ উল্লাস করেই তাদের জীবনের সকল সুযোগ নষ্ট করে ফেলে।’
সঞ্চয় করার চেষ্টাকে ত্যাগ করা উচিত না। যদি সত্যিই ধনী হতে চান তাহলে সিবোল্ডের মতানুসারে, ‘টাকার ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে কিভাবে আরো বেশি উপার্জন করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করুন।’
সাধারণত মিলিওনিয়ররা একসঙ্গে অনেকগুলো জায়গায় বিনিয়োগ করে উপার্জনের নানাবিধ পথ খোলা রাখে, এতে তাদের সঞ্চয়ের পরিমান ক্রমশ বাড়তে থাকে।
* আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি: আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করার অভ্যাস থাকলে আপনি কখনোই ধনী হতে পারবেন না। এমনকি আয় দিন দিন বাড়তে থাকার সুবাদেও নতুন খরচের খাতা খুলবেন না, জীবন যাত্রার মান ব্যয়বহুল করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন।
গ্র্যান্ট ক্যারডোন নামের একজন মিলিওনিয়ার বলেন, ‘যতক্ষণ না আমার ব্যবসা একটা নিরাপদ এবং নিশ্চিত লাভের অবস্থানে না এসেছে ততক্ষণ নিজের জন্য একটা ভালো ঘড়ি পর্যন্ত ক্রয় করি নাই। যদিও আমি কয়েক শ’ কোটি টাকার মালিক তবুও আমার সাধারণ টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়িটি নিজেই ড্রাইভ করি।’
* ঘণ্টা হিসেবে পারিশ্রমিক চাচ্ছেন: বেশিরভাগ লোক ঘণ্টা হিসেবে অথবা মাস হিসেবে পারিশ্রমিক চায়, আর ধনীরা পারিশ্রমিক অথবা লাভ চায় কাজের উপর, যত কাজ করতে পারবে তত টাকা দিতে হবে, এরকম শর্তে।
ধনী মানুষজন কিছুটা স্বাধীনচেতা, স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়। সিবোল্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকসময় এইভাবে ঘণ্টা হিসেবে টাকা দেয়া হয়, যেখানকার যে নিয়ম সেটা মানাটা জরুরি, তবে এভাবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে ঢের সময় লাগবে।
উপরে ওঠার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে স্বাধীনভাবে কাজ করা।’ সিবোল্ড আরো বলেন, ‘যেখানে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার কোটি টাকার ভাগ্য নির্মাণের খেলা চলছে, সেখানে সাধারণ লোকজন একটা নিশ্চিন্ত জীবনের জন্য নিয়মিত বেতনের একটা চাকরি আর প্রতি বছর বেতনের সঙ্গে কিছু টাকা যেন বেশি যোগ হয়, সেই আশায় বসে থাকে।’
* বিনিয়োগে অনাগ্রহ: বেশি উপার্জনের একটা সহজ উপায় হলো, অতিরিক্ত সময়ের সদ্ব্যবহার করুন, এটাই আপনার প্রথম বিনিয়োগ, যত তাড়াতাড়ি শুরু করবেন ততই ভালো। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে, ‘বেশিরভাগ কোটিপতিরা অথবা ধনীরা প্রতিবছর তাদের নিজস্ব আয়ের ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করে।’
বেস্ট সেলার ‘আই উইল টিচ ইউ টু বি রিচ’ বইয়ের লেখক রামিত শেঠির মতে, ‘প্রতি বছরের মোট উপার্জন দিয়ে কারো ধন-সম্পদ পরিমাপ করা উচিত না, বরং সঞ্চয় করার প্রক্রিয়া এবং কিভাবে অতিরিক্ত সময়কে কাজে লাগানো হচ্ছে তা দিয়ে পরিমাপ করা উচিত।’
বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য আপনাকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কলা কৌশলে দক্ষ না হলেও চলবে। এমনকি আপনাকে কোনো অভিজাত পরিবারেও জন্মাতে হবে না এবং বড় অঙ্কের টাকা উপার্জনও করতে হবে না। ব্যাংক, শেয়ার বাজার, সঞ্চয়পত্র সহ অনেক ছোট ছোট স্কিমে বিনিয়োগ করে দেখতে পারেন এবং এক সময় দেখবেন যে, এই ছোট ছোট বিনিয়োগগুলো কত বড় আকার ধারণ করেছে।
* নিজের কোনো স্বপ্ন নেই: আপনি যদি সফল হতে চান তাহলে কাজকে ভালোবাসতে হবে, তার মানে আপনার নিজস্ব স্বপ্ন থাকতে হবে, লক্ষ্য থাকতে হবে। নিজের চেষ্টায় যারা ধনবান হয়েছেন তাদের নিয়ে পাঁচ বছর ধরে গবেষণা করেছেন থমাস কোরল নামের একজন গবেষক।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ মানুষই অন্যের স্বপ্নের জন্য কাজ করে এবং এটাই তাদের বড় ধরনের ভুল। নিজের পছন্দের পেশায় এসেও যখন অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে হয় তখন বিতৃষ্ণায় হাঁপিয়ে ওঠা ছাড়া আর উপায় থাকে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘অভ্যাস সহ অনেক কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে।
তা নাহলে অতৃপ্তি এবং অসন্তোষ আপনার সবকিছুতে প্রতিফলিত হবে। অভাব অনটনেই আপনার দিন পার হবে। আসলে, সফল হওয়ার জন্য একটা গভীর ইচ্ছা দরকার আর সেই ইচ্ছাটা খুব সহজে ধরা দেয় না।’
* আরাম বলয়ের আলসে আপনি: আপনি যদি সুখ সম্পদ আর সাফল্য চান তাহলে নিশ্চিত নিরাপদ আরাম বলয় ছেড়ে বের হতে হবে। বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিরা অনিশ্চয়তার মধ্যেই সুখ খুঁজে নেন। সিবোল্ড বলেন, মধ্যবিত্তদের জীবনের সবকিছুর পেছনেই এই উদ্দেশ্যগুলো কাজ করে, তা হলো- শারীরিক, মানসিক এবং ইন্দ্রীয় সুখ।
সারা পৃথিবীর সকল চিন্তাবিদরাই জানেন যে, ধনী হওয়া সহজ নয় এবং সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, আরামপ্রিয়তা সকল উন্নতির পথকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আসলে ধনীরা জানেন যে, কিভাবে ভয়কে অতিক্রম করে ঝুঁকির জন্য প্রস্তুতি নিতে হয় এবং ক্ষতিকে সীমার মধ্যে রেখে কিভাবে সর্বোচ্চ লাভবান হওয়া যায়। আর এটাই তাদের সাফল্যের রহস্য।
* কত টাকার মালিক হতে চান, তা নিশ্চিত নন আপনি: পরিকল্পনা মাফিক কাজ করলে ধনী হওয়া একটা উপভোগ্য ব্যাপার হবে। কোনো পরিকল্পনা করার আগে আপনাকে আপনার ইচ্ছাকে স্থির করতে হবে, আপনি আসলে কত টাকার মালিক হতে চান তা স্থির করতে হবে।
আপনার মনে যা যা ইচ্ছা আছে সেগুলো লিখে ফেলুন, যেমন- আপনি একটা বাড়ি কিনতে চান, বিদেশে থাকতে চান, মাসে একবার বিদেশে ঘুরতে চান, জাঁকজমক অবসর কাটাতে চান, ইত্যাদি ইত্যাদি। ধনী ব্যক্তিরা সম্পদ অর্জনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
টি হার্ভ নামের একজন মিলিওনিয়ার বলেন, ‘ধনী হতে হলে সাহস, জ্ঞান এবং অনেক চেষ্টা দরকার। তবে সবকিছুই সম্ভব যদি আপনার লক্ষ্যকে সুনিদ্রিষ্ট ছকে ফেলতে পারেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষ যা চায় তা পায় না, কারণ তারা জানে না যে তারা কি চায়।’ ধনী ব্যক্তিরা জানে যে তারা কী চায়, তারা জানে ধন-সম্পদ চায় এবং তারা তাদের লক্ষ্যে অটুট।
* খরচ করার পর বাকী অংশ সঞ্চয় না করা: আপনি যদি ধনী হতে চান, তাহলে প্রথম সুযোগেই নিজেকে পুরস্কৃত করুন। ডেভিড ব্যাচ নামের একজন মিলিওনিয়ার তার ‘দ্য অটোমেটিক মিলিওনিয়ার’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘বেশির ভাগ মানুষই পারিশ্রমিক বা লভ্যাংশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনজন ও অন্যান্য পরিচিতদের জন্য কেনাকাটা করে, তারপর বাড়ি ভাড়া, ক্রেডিট কার্ড বিল, টেলিফোন বিল ইত্যাদি ইত্যাদি।’
সব বিল পরিশোধ করে যা থাকে তাই সঞ্চয় না করে বরং সঞ্চয় করার পর অবশিষ্টাংশ খরচ করুন। অথবা খরচের বাজেট করে প্রথমেই সঞ্চয় নিশ্চিত করুন। ব্যাচ বলেন, ‘প্রতিদিনের এক ঘণ্টার উপার্জন জরুরি প্রয়োজনের জন্য রাখুন এবং এই অভ্যাসটি চালু রাখা উচিত।’ এই ধরনের সঞ্চয়ের জন্য নিজেকেই উদ্যোগী হয়ে খেয়াল রাখতে হবে যেন সঞ্চয়ের পরিমাণ ক্রমাগতহারে বাড়তে থাকে।
* বিশ্বাস- ধনসম্পদ আপনার ভাগ্যে নেই: সিবোল্ড বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে, ভাগ্যে না থাকলে ধনী হওয়া যায় না, তবে আসল সত্য হলো, আপনি যদি পুঁজিবাদী দেশের নাগরিক হয়ে থাকেন এবং আপনার যদি কোনো বিনিময়যোগ্য ‘সেবা’ দেয়ার সামর্থ্য থাকে তাহলেই আপনার পূর্ণ অধিকার আছে ধনী হওয়ার। সুতরাং আজ থেকেই নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করুন, কেন আপনি ধনী হতে পারবেন না?’ আর বড় বড় চিন্তা করা শুরু করুন, ধনবান ব্যক্তিরা সব সময় বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান আর সেই অনুসারে চিন্তাগুলোকে আবর্তিত করেন।