যে পাঁচটি জঘন্যতম পাপের শাস্তি আল্লাহ দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন

3033

ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মুমিনের পাপ হয়ে থাকে। ফলে কেউ নিষ্পাপ নয়। একমাত্র নবী-রাসুলরাই গুনাহ থেকে মুক্ত। পাপ করা থেকে বড় অপরাধ হলো পাপ করার পর তা থেকে তাওবা না করা, ফিরে না আসা, অনুতপ্ত না হওয়া এবং বারবার পাপ করা।

আল্লাহর প্রেমিকরা পাপ করার সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে ফেলেন। সবারই জানা উচিত যে পাপের অবশ্যই একটা শাস্তি আছে। যদিও আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল। ক্ষমা করা হলো তাঁর দয়া, আর শাস্তি দেওয়া হলো তাঁর আদল বা ন্যায়বিচার।

আল্লাহ তাআলা কোনো কোনো পাপের শাস্তি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। আবার কোনো কোনো পাপের শাস্তি দিতে পরকালের জন্য বিলম্ব করেন। পাঁচটি জঘন্যতম পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায়ই দিয়ে থাকেন।

মহানবী (সা.) বলেছেন—১. কোনো জাতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে আল্লাহ তাআলা শত্রুদের তাদের ওপর চাপিয়ে দেন। ২. আল্লাহ প্রদত্ত বিধান ছাড়া বিচার ফায়সালা করা হলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য বিস্তারলাভ করে।

৩. কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার বিস্তারলাভ করলে তাদের মধ্যে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। ৪. কোনো জাতি পরিমাপে ও ওজনে কম দিলে তাদের ফসলহানি ঘটে এবং দুর্ভিক্ষ তাদের পাকড়াও করে। ৫. আর কোনো জাতি জাকাত দিতে অস্বীকার করলে, তাদের মধ্যে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয় (বাজজার, মুয়াত্তা)।

১। অঙ্গীকার পূর্ণ করা : অঙ্গীকার পূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম গুণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ প্রসঙ্গে অনেক গুরুত্ব বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো।

অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল : ৩৪)। অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো।’ (সুরা : মায়েদা : ১)। আরো ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণ করো।’

(আল আনয়াম : ১৫২) অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘(বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরা এমন) যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।’ (সুরা : রাদ : ২০) আরো ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সে অঙ্গীকার পূর্ণ করো।’ (সুরা : নাহল : ৯১)। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হারাম এবং মুনাফেকি।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘চারটি দোষ যায় মধ্যে থাকবে সে পরিপূর্ণ মুনাফিক। আর যার মধ্যে এসবের একটি দোষ থাকবে, তার মধ্যে মুনাফেকির একটি উপাদান থাকবে, যতক্ষণ সে তা বর্জন না করে, কথা বললে মিথ্যা বলে, আমানত রাখলে খেয়ানত করে, অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে এবং ঝগড়া করলে সীমা ছাড়িয়ে ফেলে।’

(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি বিচার দিবসে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। ১. যে ব্যক্তি অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে, ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে এবং

৩. যে ব্যক্তি কোনো কর্মচারী নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না’ (সহিহ বুখারি)। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো নেতার আনুগত্যের অঙ্গীকার করে, তার উচিত সাধ্যমতো তার আনুগত্য করা (সহিহ মুসলিম)।

২। কোরআন অনুযায়ী বিচার না করা : কোরআন অনুযায়ী বিচার করা আবশ্যক। কোরআনবর্জিত বিচারকার্য করা মুনাফেকি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী যারা বিচার করে না তারা কাফির।’ (সুরা : মায়েদা : ৪৪)।

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা জালিম।’ (সুরা : মায়েদা : ৪৫)। যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, তারা ফাসিক (সুরা : মায়েদা : ৪৭)।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে বিচারক আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, আল্লাহ তার নামাজ কবুল করেন না।’ (হাকেম)। হজরত ফুজাইল ইবন ইয়াজ বলেন, ‘একজন বিচারপতির উচিত এক দিন বিচারকার্য পরিচালনা করা, আর এক দিন নিজের জন্য কান্নাকাটি করা।’

৩। ব্যভিচার করা : ব্যভিচার করা মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারের কাছেও যেতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। তা একটি অশ্লীল কাজ এবং খারাপ পন্থা।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল : ৩২)। ব্যভিচারের শাস্তিও মারাত্মক।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘(অবিবাহিত) ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারিণী নারী উভয়কে ১০০ করে বেত্রাঘাত করো।’ (সুরা : আন নূর : ২)। আর বিবাহিত হলে তাদের শাস্তি হলো, কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে হ”ত্যা করা।

মহানবী (সা.) বলেছেন, বিচার দিবসে তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না ও তাদের পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নির্ধারিত থাকবে। তারা হলো ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক এবং অহংকারী দরিদ্র। হজরত ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল!

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা। অথচ তিনি প্রত্যেক প্রাণীর স্রষ্টা। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, তারপর কী? তিনি বললেন, তোমার সন্তান তোমার সঙ্গে আহার করবে—এ আশঙ্কায় তাকে হ’ত্যা করা। আমি আবার আরজ করলাম, তারপর কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে তোমার ব্যভিচার করা। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।

আল্লামা জাজিরি (রা.) তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ব্যভিচার ও এর প্রভাবের ক্ষতি অগণিত। এতে চারিত্রিক, ধর্মীয়, শারীরিক, সামাজিক, পারিবারিক সর্বোপরি পাপ কাজে জড়িয়ে পাপিষ্ট হওয়ার ক্ষতি রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারীর দোয়া কবুল করেন না। তার থেকে ঈমানের নূর চলে যায়। যেখানে ব্যভিচার চলে, সেখানে রহমতের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। ব্যভিচার চুরি, হ’ত্যা ইত্যাদি থেকেও মা’রা’ত্ম’ক। ব্য’ভি’চা’রে’র ফলে এইডসের মতো কঠিন রোগ হয়।

৪। পরিমাপ ও ওজনে কম দেওয়া : পরিমাপ ও ওজনে কম দেওয়া করিরা গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য দুর্ভোগ, যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয়, আর যখন লোকদের মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়।’ (সুরা : আত-তাফফিফ ১-৬)।

আরো ইরশাদ করেন, মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করবে। এটা উত্তম, এর পরিণাম শুভ (সুরা : বনি ইসরাঈল : ৩৫)। অন্যত্র ইরশাদ করেন, সোজা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। মানুষকে তাদের বস্তু কম দিও না’ (সুরা : শুয়ারা : ১৮২-১৮৩)। আরো ইরশাদ করেন, ন্যায়ের সঙ্গে ওজন ও মাপ পূর্ণ করো (সুরা : আনআম : ১৫২)। হজরত শুয়াইব (আ.) তাঁর জাতিকে বলেছিলেন, তোমরা মাপ ও ওজনে পূর্ণ করো এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়ো না। (সুরা : আরাফ : ৮৫)

৫। জাকাত না দেওয়া : জাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি এবং আর্থিক ইবাদত। কোরআন মজিদে যত স্থানে নামাজ কায়েম করার কথা রয়েছে, সেখানে জাকাত দাও—এ কথাও রয়েছে। স্বীয় সম্পদকে পবিত্র করার উত্তম পন্থা হলো জাকাত প্রদান। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর নামাজ কায়েম করো, জাকাত দান করো এবং নামাজে অবনত হও তাদের সঙ্গে যারা অবনত হয়।’ (সুরা : বাকারা : ৪৩)। আরো ইরশাদ করেন, আপনি তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করেন, যা দ্বারা তাদের পবিত্র এবং পরিশোধিত করবেন। (সুরা : তওবা : ১০৩)।

মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদের জাকাত আদায় করো। আল্লামা শামি বলেছেন, জাকাত প্রদানের দ্বারা সম্পদে বরকত হয়। (রদ্দুল মুহতার, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১)। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, জাকাত প্রদানের ফলে দাতার মন ও আত্মা পবিত্র হয়, ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায় ও পরিচ্ছন্ন হয়।

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।