বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠছে আরেক বাংলাদেশ

1406

আকবর হোসেন সোহাগ, নোয়াখালী: জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সিংহভাগ ভূখন্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে যে সময়ে, ঠিক তখনই জনমনে সীমাহীন আশা জাগিয়ে নোয়াখালীর উপকূলীয় মেঘনার বুকে নতুন নতুন চর জাগছে।

বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠেছে নিঝুমদ্বীপ, স্বর্ণদ্বীপ ও ভাসানচরসহ অনেক চর। এক কথায় আগামী এক দশকে হাতিয়া উপজেলার আয়তন হবে একটি বিশাল আয়তনের জেলার সমান।

মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় যে পরিমাণ ভূমি বিলীন হচ্ছে- তেমনিভাবে চারপাশে অন্তত ১০ গুণ ভূমি জেগে উঠছে।

নিঝুমদ্বীপ থেকে মুক্তারিয়া ঘাটসহ কয়েকটি স্থানে ক্রস ড্যাম আর প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ওই এলাকার আয়তন দাঁড়াবে প্রায় ১৫ হাজার বর্গমাইল। প্রতি বছর নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় ৭০ হাজার হেক্টর ভূমি জাগছে।

বঙ্গোপসাগরের বুকে দেখা দিয়েছে আরেকটি বাংলাদেশের হাতছানি। এ ছাড়া নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। পাল্টে যাবে দুই উপজেলার চিত্র।

হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন। গত তিন দশকে জেগে ওঠা নতুন চরে ৩টি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কমপক্ষে আরও ৮/১০টি ইউনিয়নের সমপরিমাণ আয়তনের ভূমি জেগেছে।

হাতিয়ার হরণি ও চানন্দী ইউনিয়নের সীমানা পেরিয়ে পূর্ব-দক্ষিণে বিশাল ভূমি এখন স্বর্ণদ্বীপ হিসেবে পরিচিত। স্বর্ণদ্বীপের আয়তন একটি উপজেলার আয়তনের প্রায় সমান। স্বর্ণদ্বীপের ১৫ কিলোমিটার মেঘনা পেরিয়ে দক্ষিণে ভাসানচরের অবস্থান।

অবকাঠামো নির্মাণ শেষে ভাসানচরে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। ভাসানচরের আয়তন প্রায় ২৫০ বর্গ কিলোমিটার। ভাসানচরের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে ১০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের গাঙ্গুরিয়ার চরের অবস্থান। আগামী ৪/৫ বছরের মধ্যে এই চরে চাষাবাদ শুরু হবে।

এ ছাড়া হাতিয়ার দক্ষিণে নিঝুমদ্বীপ, পশ্চিম পাশে ঢাল চর, চর মোহাম্মদ আলী, চর ইউনুস, চর আউয়াল, মৌলভীর চর, তমরদ্দির চর, জাগলার চর, উত্তরে নলের চর, কেয়ারিং চর, ইসলাম চর, জাহাজ্জের চর (স্বর্ণদ্বীপ), নঙ্গলীয়ার চর, সাহেব আলীর চর, দক্ষিণে কালাম চর, রাস্তার চরসহ অন্তত ১৫টি দ্বীপ ১৫/২০ বছর আগ থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠেছে।

এ ছাড়া উড়ির চরের পাশেও কয়েকটি চর জাগছে। হাতিয়া দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে দুই দশক পূর্বে জেগে ওঠা চর নূর ইসলামে এখন চাষাবাদ চলছে। অপরদিকে বুড়িরচর ইউনিয়নের রহমত বাজারের দেড় কিলোমিটার পূর্বে মেঘনায় গত এক দশকে অন্তত ৫০ বর্গকিলোমিটার ভূমি জেগেছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বুড়িরচর ইউনিয়নের পূর্ব-দক্ষিণে কালিরচর পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি ইউনিয়ন আয়তনের সমান ভূমিতে জনবসতি গড়ে ওঠার পাশাপাশি এখানে চাষাবাদ ও শুঁটকি তৈরি হচ্ছে।

কালির চরের পূর্ব ও দক্ষিণে সাগরের বুক চিরে আগামী দেড় দশকে আরও চার শতাধিক বর্গকিলোমিটার ভূমি জেগে ওঠার আশা করছে স্থানীয় অধিবাসীরা। হাতিয়া উপজেলার পশ্চিমে তমরদ্দি ঘাট থেকে পশ্চিমে ভোলার মনপুরা উপজেলা।

তমরদ্দি নৌঘাট থেকে মনপুরা উপজেলার দূরত্ব ৮/৯ বর্গমাইল। গত ৮/১০ বছর দুই পার্শ্বের হাতিয়া নদীতে সাতটি চর জেগেছে। এর মধ্যে কলাতলী, তেলিয়ারচর, বদনার চর, ঢালচর ও মৌলভীর চরে বনায়ন ও চাষাবাদ চলছে। আগামী এক দশকে এসব চরের আয়তন হবে প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার।

এগুলোর মধ্যেও নিঝুমদ্বীপে ৭০-৭৫ হাজার মানুষ বসবাস করছে। এ ছাড়া ঢাল চর, নলের চর, কেয়ারিং চর, মৌলভির চরসহ কয়েকটি দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছে। একইভাবে বনবিভাগ আবাদ করে সবুজ বনায়ন করেছে। জলদস্যুদের ভয়ে বাকিগুলোতে এখনো বসবাস শুরু হয়নি।

এখনো অন্তত ৩০/৪০টি ডুবো চর রয়েছে যেগুলো আগামী ৫/৭ বছরের মধ্যেও জেগে উঠতে পারে। এসব চর ভাটায় দেখা গেলেও জোয়ারের পানিতে এখনো ডুবে যায়। এ ব্যাপারে নোয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বিপুল কৃষ্ণ দাস জানান, প্রতি বছর নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় ৭০ হাজার হেক্টর ভূমি জাগছে।

এর মধ্যে স্বর্ণদ্বীপের ৮৭ হাজার একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে কিছু পানির মধ্যে রয়েছে। হরিণের খাদ্যের জন্য নতুন নতুন প্রজাতির গাছ লাগানোর প্রস্তুতি চলছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য নৌবাহিনীর মাধ্যমে ভাসানচর প্রস্তুত করা হয়েছে।

২৫ হাজার হেক্টর জমিতে ২টি প্রজেক্টের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ বনায়নের কাজ শুরু করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি প্রজেক্টের কাজ চলছে। ভাসানচরের দক্ষিণে ও হাতিয়ার উত্তর অংশে জনতা বাজার এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।

এই অঞ্চলে আরও নতুন নতুন বনায়ন করতে পারলে ভাঙন কিছুটা রোধ পাবে, আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. খোরশেদ আলম খান জানান, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে কোম্পানীগঞ্জের জন্য ৪৮৩৫ একর ভূমি ও সুবর্ণচরের জন্য ৭৭৯ একর ভূমি বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। এই দুই উপজেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এখানে ব্যাপক শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হলে পাল্টে যাবে দুই উপজেলার জীবন যাত্রা, হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর ৫০ হাজার হেক্টর নতুন ভূমি জাগছে। তবে এর মধ্যে ৩০ হাজার নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে।

এর পরেও মূল ভূখন্ডের সঙ্গে ২০ হাজার যোগ হচ্ছে। এগুলোতে বনায়ন করা হচ্ছে। তিনি জানান, নতুন নতুন চরগুলোতে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া অবৈধ দখলে থাকা খাস জমিগুলো উদ্ধার করে ভূমিহীনদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।